মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
বিয়ের পর আমার সন্তান হচ্ছিল না,কত চিকিৎসা করাইছি,কত সাধনা করছি। আট বছর আল্লাহর কাছে কাইন্দা আমি নিরবরে পাইছিলাম। ওরা আমার ১৮ বছরের ছেলেটারে এমনে মাইরা ফালাইলো? আমার ছেলেটা বাঁচার জন্য নাজানি কত ছটফট করছে।
আমারে মা মা বইলা ডাকছে। নিরব আর আমারে বলবো না মা দশটা টাকা দাও আমি কিছু খামু। বাড়িতে আইসা কইবো না মা খিদা লাগছে ভাত দাও।
শনিবার দুপুরে ছেলে নিবর হত্যার মামলা করতে এসে এভাবেই বিলাপ করছিলেন মা দিলারা বেগম নিপা (৪৩)। ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় শুক্রবার বিকালে তাঁর ছেলে নীরব হোসেন(১৭)কে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে বখাটেরা।
শ্রীনগর থানার গোলঘরে বসে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় তিনি বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন আর বিলাপ করছিলেন। এসময় দিলারা বেগমের অর্তনাদে সংবাদকর্মী সহ উপস্থিত লোকজনের চোখ ভিজে উঠে।
এসময় তিনি বলেন, ওরা পোলাডারে না জানি কত কষ্ট দিয়া মারছে। ওরা যদি নিরবরে জানে না মাইরা দুইডা হাত-পা কাইট্টা দিত, তারপরও পোলাডা বাঁইচ্যা থাকত,আমারে মা বইলা ডাকত। আমি আমার বাবাটাকে দেখতাম। ওরা আমার বুকটা শূণ্য করে দিলো।
তিনি প্রশ্ন তুলেন,দেশের কেমন আইন জনসন্মুখে আমার সন্তানটারে মাইরা গেলগা। আমার সন্তানতো কারো ক্ষতি করে নাই।
দিলারা বেগম বলেন,চাঁদপুরের দেলোয়ার হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়। বড় ছেলে নিরবের পর তার ছোট ছেলে নাজমুল হাসানের জন্ম। স্বামী সন্তান নিয়ে তারা ঢাকার মিরপুরে বসবাস করতেন। তার স্বামী দেলোয়ার হোসেন বান্ডিংয়ের ব্যবসা করতেন। নিরবের বয়স যখন ৫ আর নাজমুলের ১ তখন তার স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর ৫ দিনের মাথায় মারা যান তার বাবাও। স্বামী ও বাবাকে হারিয়ে তিনি ২ ছেলেকে নিয়ে অন্ধকারে পরে যান।
কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি বলেন, এরপর জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে বাবার বাড়িতে এসে পোলা দুইডারে নিয়ে বাঁইচ্যা ছিলাম। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা ও টিউশনি করে নীরবদের পড়াশোনা করিয়েছি। রাত দিন নিজে কষ্ট করেছি কিন্তু ছেলেদের কষ্ট করতে দেই নাই।
নিরব আমার বড় ছেলে। ওরে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল আমার। আমার কষ্ট দেখে আমার বাবায় প্রায়ই বলতো মা আমারে বিদেশ পাঠাইয়া দেও।
আমি বলতাম বাবা পড়ালেখাটা করো পরে কাজে যাইও। তারপরও বলছে এবার পরীক্ষার পর কোথাও কাজ নেবে। সংসারের হাল ধরবে। একটি সুপার শপে কাজের জন্য সিভি দিবে বলে শুক্রবার সন্ধ্যায় ওর ছবি উঠানোর কথা ছিল। কাজ করে আর আমাকে কষ্ট করতে দেবে না। অথচ আমারে কষ্টের সাগরে ভাসায়ে চলে গেল।
তিনি তার সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে বলেন, এমন ঘটনা যেন কোনো অসহায় মায়ের সঙ্গে আর না ঘটে।
নীরবের নানি মাবিয়া বেগম বলেন, অল্প বয়সে নীরবের মা স্বামীহারা হয়। দুই ছেলের কথা চিন্তা করে আর দ্বিতীয়বার সংসার করেনি। ফজরের নামাজের পর থেকে টিউশনি শুরু করতো পরে স্কুলে যেত। বিকেল থেকে আবার রাত পর্যন্ত টিউশনি করে ছেলেদের মানুষ করছিল। আমার জনম দুখি মেয়ের আদরের ধন ওরা কেমনে মাইরা ফালাইলো।
গত বৃহস্পতিবার কাজী ফজলুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান চলাকালে কিশোর গ্যাংয়ের ১২ থেকে ১৫ জন মিলে স্কুলের ছাত্রীদের উত্যক্ত করতে থাকে।
এসময় সাব্বির,নিরব ও কাজী অহিদুল উত্যক্তের প্রতিবাদ করায় বখাটেদের সাথে তাদের বাক বিতন্ডা ও হাতাহাতি হয়। পরে বখাটেরা দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। এর জের ধরে শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে কাজী ফজলুল হক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রায় একশ গজ পশ্চিমে কামারগাও চৌধুরীবাড়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শহিদ মিনারের পাশে এসে বখাটেরা
নিরবকে ছুরিকাঘাত করে পার্শ্ববর্তী খালে ফেলে দেয়। স্থানীয়রা নিরবকে উদ্ধার করে শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।