মাসুমা জাহান,বরিশাল ব্যুরো: কাঁধে পানির জার বহন করে ঝালকাঠি শহরের বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় পানি সরবরাহ করেন গণেশ শীল (৬৫)। একটি বাঁশের দুই মাথায় বাঁধা দুটি টিনের জারে সকাল-বিকেল নদী বা পুকুরের পানি ভরে পৌঁছে দেন হোটেল-রেস্তোরায়।এই পানি রান্নার কাজে ব্যবহার করে হোটেল–রেস্তোরাঁ গুলো। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ‘ভারওয়ালা’ বলে ডাকে।
৩০ বছর ধরে একই কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন গণেশ শীল। এই স্বল্প উপার্জন দিয়েই দুই সন্তানকে পড়ালেখা করিয়েছেন। তাঁর ছেলে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) পড়াশোনা করায় স্থানীয় অনেকেই তাঁকে এখন ‘ইঞ্জিনিয়ারের বাবা’ বলে ডাকেন।
ঝালকাঠি শহরে ৮০ ও ৯০–এর দশকে শতাধিক ‘ভারওয়ালা’ এ পেশায় জড়িত ছিলেন। কালের বিবর্তনে অন্যরা এই পেশা ছেড়ে দিলেও গণেশ শীল একই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে যাচ্ছেন। শহরের টিএনটি সড়কে একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে রান্নার কাজে ব্যবহৃত পানি দেওয়ার সময় কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছেলে প্রকৌশলী হয়ে গেলেই পানি টানা বন্ধ করে দেব। তখন আর কষ্ট থাকবে না।
প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হয় জানিয়ে গণেশ শীল বলেন, আগে এক কক্ষের বাসায় থাকলেও এখন দুই কক্ষের বাসা নিয়েছেন। তবে নিত্য পণ্যের দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় চিন্তায় পড়ে গেছেন। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হয়।
সংগ্রামী এই মানুষটি জানান, তাঁর বাড়ি বরগুনার বেতাগীতে হলেও শৈশবেই তিনি চলে আসেন ঝালকাঠি শহরে। এর পর থেকে শহরের বিভিন্ন হোটল-রেস্তোরাঁয় পানি দেওয়ার কাজ করে আসছেন। বিয়ে করে পৌর শহরের শীতলা খোলার মোড়ে ছোট একটি ভাড়ার বাসায় সংসার শুরু করেন। সংসার আলো করে আসে এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারা বরাবরই লেখাপড়ায় ভালো।
ছেলে সৌরভ শীল (২৫) কুয়েটে প্রথম সেমিস্টারে পড়ছেন। মেয়ে প্রিয়াংকা শীল বেতাগীর একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তাঁর স্বামী একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেন। ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগাতেই এই বয়সেও পানির জার বহনের কাজ করে যাচ্ছেন গণেশ শীল।
ছেলে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করলে আর কষ্ট করতে হবে না—এমনই স্বপ্ন দেখেন গণেশ শীল। বিনয়ী মানুষটি বলেন, বয়স অনেক হয়েছে। তাই শরীর আর আগের মতো পানির ভার টানতে সায় দেয় না। তবে ছেলের লেখাপড়ায় অনেক খরচ। তাই এই বয়সেও কাজটি করতে হচ্ছে। তবে মেয়ে এখন সংসারে কিছু সাহায্য করে।
কথা বলতে বলতে গণেশ শীল প্রথম জীবনে ফিরে যান। বলেন, ‘৩০ বছর আগে হোটেলে প্রতি জার পানি দিলে দুই টাকা পেতাম। এভাবে দিনে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হতো। তা দিয়ে সংসারের খরচসহ ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি। শত কষ্টের মধ্যেও অন্যের কাছে হাত পাতিনি। ছেলে-মেয়ে দুটো লেখাপড়ায় ভালো হওয়ায় ওদের দিয়ে কোনো কাজ করাইনি।
কথা শেষ করে কাঁধে টিনের জার নিয়ে আবার পানি আনতে ছোটেন গণেশ শীল। অনেকেই সামনে পেয়ে তাঁর কুশল জিজ্ঞেস করেন। কেউ কেউ তাঁকে ‘ইঞ্জিনিয়ারের বাবা’ বলে সম্বোধন করেন।
গণেশ শীলের শ্যালক যুগল শীল বলেন, ‘আমার বোন জামাই জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন। ছেলে-মেয়ে দুটোকে মানুষ করেছেন। তবে কখনো কারও সাহায্য নেননি। তাঁকে নিয়ে আমরা গর্ব করি।
ছোটবেলা থেকেই গণেশ শীলকে দেখে আসছেন জানিয়ে তাঁর প্রতিবেশী কলেজ শিক্ষক আকবর হোসেন বলেন, ‘তিনি অত্যন্ত বিনয়ী ও ভালো মানুষ। অনেক পরিশ্রম করে ছেলে-মেয়েকে মানুষ করেছেন। আমি তাঁর মঙ্গল কামনা করছি।