খন্দকার মোঃ জসীম উদ্দিন, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
বাংলাদেশের যে কতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ার সৌভাগ্য খুব কম ছাত্র-ছাত্রী হয়। বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা ঐতিহাসিক। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেনি। জাতির যেকোনো দুর্যোগময় মুহূর্তে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের অনন্য মেধা এবং দেশপ্রেম এই জাতির জন্য অহংকার। সামরিক স্বৈরাচার থেকে আরম্ভ করে যেকোনো নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা আপসহীন ভূমিকা পালন করেছেন। এর ফলে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেক শিক্ষার্থীকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে।
‘৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের যখন পতন ঘটে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের আপসহীন ভূমিকার কারণে স্বৈরাচার জেলে থাকতে বাধ্য হয়। ‘৯০-এর অভ্যুত্থানের পর থেকে ছাত্রসমাজ তার নৈতিক মনোবল হারাতে শুরু করে। তারা গণতান্ত্রিক হোক আর স্বৈরাচারী সরকার হোক এদের সঙ্গে একধরনের আপসকামী ভূমিকা অবতীর্ণ হয়। ছাত্র নেতৃত্ব একধরনের আদর্শচ্যূত হতে শুরু করে। তারা বৃহত্তর সমাজের কল্যাণে না ভেবে ব্যক্তি স্বার্থের দিকে নজর দিতে শুরু করে। এর ফলে ‘৫২, ‘৫৪, ‘৬৯ ও ‘৭১-এর ছাত্রসমাজের ঐতিহ্য, তা ধ্বংস হতে আরম্ভ করে। ছাত্ররা শতভাগ লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে।
অপর দিকে ছাত্রদের এই দুর্বলতায় ‘৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সফল ছাত্রসমাজ ধুলিস্যাৎ করে ফেলে। তারা তাদের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে রাজনৈতিক দলের লাঠিয়ালে পরিণত হয়। তারা বিভিন্ন দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন হিসেবে বিভক্ত হয়ে একদল অপর দলের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ঝুঁকিবিহীন, পুঁজিবিহীন অধিক মুনাফার পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি এখানে শক্তপোক্ত অবস্থান গেঁড়ে বসে। দেশটি হয়ে যায় দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়। দেশে দেখা দেয় মারাত্মক রাজনৈতিক বিপর্যয়। রাজনৈতিক ন্যূনতম শালীনতা ধ্বংস হয়ে যায়। “৭১ থেকে ‘৯০ পর্যন্ত যতগুলো সফল আন্দোলন হয়েছে, সবগুলো মাঠে মারা পড়ে। নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির যে সুফল, জাতি তা থেকে বঞ্চিত হয়। সুকৌশলে জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির কারখানা ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর কারণ পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির অলিখিত বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের প্রত্যেকটা কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যদি প্রতিবছর সঠিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে হাজার হাজার ছাত্রনেতা তথা জাতীয় নেতা বেরিয়ে আসে। এর ফলে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি সমূলে নির্মূল হয়ে যায়। রাজনীতিক দলগুলো কৌশলে তা বন্ধ করে দেয় এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচন একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে মজুতদার, মুনাফাখোর, চোরাচালানকারী,, কালোবাজারি, সোনা চোরাচালানকারী, ভূমিদস্যু, অসৎ প্রশাসনিক আমলা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে। ফলে দেশপ্রেমের দায়বদ্ধতাহীন মানসিকতার কারণে দেশের মানুষ এসব ব্যক্তির কর্মকান্ডে রাজনীতির প্রতি একধরনের ঘৃণা পোষণ করে। আর রাজনীতি তখন সম্পূর্ণ খারাপ মানুষের হাতে চলে যায়। এর ফলে তথাকথিত ছাত্ররাজনীতিতে কুসন্তানগুলো জড়িয়ে পড়ে। তারা শিক্ষার পরিবেশ সম্পূর্ণ বিঘ্নিত করে ফেলে। ধর্ষণ থেকে আরম্ভ করে এমন কোনো অসামাজিক কাজ নেই, যা তারা করে না। সর্বোপরি তারা তাদের সহপাঠীকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল বুয়েটে। এই ঘটনা শিকার মেধাবী ছাত্র আবরার। ফলে বুয়েটের সব ছাত্র একত্রিত হয়ে এখানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে প্রশাসনকে বাধ্য করে। বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ছাত্রদের উদ্যোগ শতভাগ কার্যকর হয়। বুয়েটের এই ঘটনার সাথে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন জড়িয়ে পড়ে। বুয়েটে তাদের মারাত্মক রাজনৈতিক পরাজয় ঘটে। এই পরাজয়ের মাশুল তাদের এখনো দিতে হচ্ছে। বুয়েটে লেখাপড়া করে অধিকাংশই গ্রামের খেটে খাওয়া কৃষক-শ্রমিক গরিব-দুখী মা-বাবাদের সন্তান। অপর দিকে এই সন্তানগুলো বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মেধাবী।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা দলগুলো সফলকাম হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত রাজনীতিবিমুখ করে ফেলার। এর সুফল তারা পেতে থাকে। কিন্তু জাতির যতটুকু ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে যায়। ছাত্রসমাজ আস্তে আস্তে রাজনীতিবিমুখ হতে থাকে। দেশের সর্বনাশ হয়ে যায়। কারণ সর্ব অবস্থায় একটি দেশের চালিকাশক্তি ওই দেশের রাজনৈতিক দল তথা নেতৃত্ব। মেধাবী ছাত্রসমাজ রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলে সেই শূন্যস্থান পূরণ করে অখাদ্য-কুখাদ্য তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা। আজ বুয়েটের কোনো ছাত্রই ছাত্ররাজনীতি বুয়েটে সচল হোক তা চায় না! অপর দিকে সরকারের প্রতি একধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হয়। সরকার সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বুয়েটের ১১ জন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী বুয়েট শহীদ মিনারে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। এ ঘটনাটি দেখে কারও কারও অভিমত, সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের একই অবস্থা। ছাত্রলীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল ছাত্রসংগঠনের পরিণত হচ্ছে!
অপর দিকে মহামান্য আদালত বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি করার অধিকার প্রদান করেন। দেশবাসীর আশা সরকার এবং বুয়েটের শিক্ষার্থীর মধ্যে যেন কোনো সংঘাত না লাগে। ক্ষমতাসীন সরকারকে বুঝতে হবে, তাদের পায়ের নিচে কতটুকু মাটি আছে এবং আগামী দিনে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী?
এখন আসি অন্য প্রসঙ্গে, একসময় দীর্ঘদিন কারাবরণকারী জল্লাদ শাহজাহান। তিনি জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর পৃথিবী নামক জেলখানায় তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। অভিজ্ঞতা কতটুকু সুখকর তা তাঁর কথা থেকেই অনুধাবন করা যায়। জেল থেকে বের হওয়ার পর ভাগনাসহ বউ-শাশুড়ির প্রতারণা এবং বর্তমানে জীবন-জীবিকার মারাত্মক সমস্যার কথা তাঁর বক্তব্য উঠে এসেছে। পরিশেষে তাঁর কথায় যা বোঝা গেল, বাংলাদেশ নামক এই দেশে।