মাসুমা জাহান,বরিশাল ব্যুরোঃ
ঝালকাঠি শহরের পালবাড়ির ঐতিহ্যবাহী অতুল মাঝির খেয়াঘাটে ৪০ বছর ধরে মানুষ পারাপার করেন রাঙ্গা মাঝি (৭৫)। এই ঘাটে আরও ১২ জন মাঝি মানুষ পারাপারের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন বর্তমানে।এত বছরেও রাঙ্গা মাঝিদের জীবনের চাকা ঘোরেনি, কাটেনি দুর্দশা। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তাঁরা এখন দিশেহারা।
চার দশকে অনেক শিক্ষার্থী, অসহায় মানুষকে বিনা পয়সায় নদী পার করেছেন রাঙ্গা মাঝি। গভীর রাতে খেয়াঘাটে ডাক দিলেই সাড়া দিয়ে তিনি বিপদে পড়া মানুষকে পার করেছেন। ঘাটপাড় থেকে অসুস্থ রোগীর জরুরি ওষুধ এনে দেওয়াও ছিল তাঁর নিত্যদিনের কাজ। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে সংসারের খরচা বেড়ে গেছে। পরিবার–পরিজন নিয়ে অস্থির সময় পার করছেন রাঙ্গা মাঝি। শুধু রাঙ্গা মাঝি নন, অতুল মাঝির খেয়াঘাটের ১২ জন মাঝিরও একই দশা। তাঁদের আয় বাড়েনি, রয়ে গেছে সাংসারিক টানাপোড়েন।
প্রতিদিন ছয়টি নৌকা ভাগাভাগি করে এক বেলা মানুষ পারাপারের সুযোগ পান মাঝিরা। যাত্রীরা এক পারে ভাড়া দেন দুই টাকা। ঘাটের ইজারাদারকে নৌকার ভাড়া বাবদ ৭০ টাকা দিয়ে মাঝিদের হাতে ৩০০ টাকার বেশি থাকে না। সেই টাকা দিয়ে কোনো মতে সংসার চালান তাঁরা।
ঝালকাঠি পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, শহরের পালবাড়ি থেকে পৌরসভার ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা যাতায়াতের জন্য শত বছরের পুরোনো অতুল মাঝির খেয়াঘাটটি ব্যবহার করে থাকেন। ঘাটটি বংশ পরম্পরায় সদরের ওমেশগঞ্জ এলাকার প্রয়াত অতুল মজুমদারের পরিবার পৌরসভা থেকে ইজারা নিয়ে ঘাট পরিচালনা করে আসছে।
প্রতিদিন ছয়টি নৌকা ভাগাভাগি করে এক বেলা মানুষ পারাপারের সুযোগ পান মাঝিরা। যাত্রীরা এক পারে ভাড়া দেন দুই টাকা।
সম্প্রতি অতুল মাঝির খেয়াঘাটে রাঙ্গা মাঝির সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘দুই পারের মাইনষের প্রয়োজনে অনেক ঝাঁপাইয়া পড়ছি। রাতে না ঘুমাইয়া বিপদে পড়া মানুষ পার করছি। অনেক অসুস্থ মাইনসের লাইগা রাতে ঘাটের শহরের পাড় থেইক্যা ওষুধ আইন্না বাড়ি দিয়া আইছি। আবার বাজার সদাই পার কইরা দিছি। এহন বয়স অইয়া গ্যাছে। আগের নাহান রাইতে নৌকা বাইতে পারি না। অনেক ছাত্র বিনা পয়সায় পার করছি। তারা আইজ অনেকে বড় চাকরি করে। অনেকে দ্যাশে আইলে সাহায্য টাহায্য করে।
জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার বিষয়ে রাঙ্গা মাঝি বলেন, ‘নৌকা চালাইয়া ধারদেনা কইরা ছয় মাইয়া বিয়া দিছি। যা কামাই করি হেয়া দিয়া মাইনসের দেনা শোধ করি। বাজারে যাইয়া মাছের দর করার সাহস পাই না। দুই বেলা প্রায়ই আলুভর্তা, ডাইল দিয়া চালাইয়া দিই। আমার ভাগ্য ভালা ছয় মাইয়ার বিয়া দিছি। নাইলে সংসারে খরচ আরও বাড়ত। তয় অন্য মাঝিগো অবস্থা আরও খারাপ।
এই ঘাটে যাত্রী পারাপার কমে গেছে। তাই নৌকার সংখ্যাও কমানো হয়েছে। এক বেলা করে নৌকা চালিয়ে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে মাঝিদের সংসার চলে না।
রাঙ্গা মাঝি ছাড়াও কথা হয় ছত্তার মাঝি, রব মাঝি, শ্যামল মাঝি, আলাউদ্দিন মাঝি ও ফরিদ মাঝির সঙ্গে। ছত্তার মাঝি বলেন, ‘এক বেলা নৌকা বাই, আবার রাইতেও মানুষ পারাপার করি। সব শ্যাষে ইনকাম ৩০০ টাহার বেশি হয় না। এয়া দিয়া পাঁচজনের সংসারে চাউলে, ডাইল কিন্না কিছু থাহে না। মাসের শ্যাষে দোহানে বাহিতে সদাই কেনতে অয়।
পশ্চিম ঝালকাঠি এলাকার বাসিন্দা নিয়াজ হিজবুল্লাহ বলেন, ১৯৯৪ সালে নেছারাবাদ মাদ্রাসার খালিদ সাইফুল্লাহ নামের এক নিখোঁজ ছাত্রের লাশ রাঙ্গা মাঝি বাসন্ডা খাল থেকে তুলে আনেন। তিনি অনেক সাহসী ও পরোপকারী মানুষ।
মোহাম্মদ আজিম নামের কিফাইতনগর এলাকার এক ব্যাক্তি বলেন, ‘আমাদের ছাত্রজীবনে এই ঘাটের মাঝিরা ভাড়া না থাকলেও বিনা পয়সায় পারাপার করে দিতেন। কারও কিছু নদীতে পড়ে গেলে তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়ে তা খুঁজে দিতেন। অথচ তাঁদের আয় বাড়েনি, জীবনের দুর্দশাও কাটেনি।
ঘাটের ইজারাদার স্বপন মজুমদার বলেন, এই ঘাটে যাত্রী পারাপার কমে গেছে। তাই নৌকার সংখ্যাও কমানো হয়েছে। এক বেলা করে নৌকা চালিয়ে যে টাকা আয় হয়, তা দিয়ে মাঝিদের সংসার চলে না।