মাসুমা জাহান,বরিশাল ব্যুরোঃ
আজ সেই ভয়াল ২৪ ডিসেম্বর গত বছর আজকের দিনে বরগুনাগামী এমভি অভিজান۔১০ এ রাত প্রায় আড়াইটা বাজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।মর্মান্তিক সেই দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ৪৯ যাত্রী।সে সময় পরিবারের সঙ্গে লঞ্চেই ছিলেন ইসরাত জাহান।নিজে দগ্ধ হয়ে বেঁচে ফিরলেও হারিয়েছেন মাকে।তাঁর কাছে মর্মস্পর্শী সেই মুহূর্তের গল্প শুনেছেন এই প্রতিবেদক|
অগ্নিকান্ডে বেঁচে যাওয়া যাত্রী ইসরাত জাহান জানান সেদিনের সেই দুর্বিসহ বিভীষিকাময় অগ্নিকাণ্ডের কথা| কেরানীগঞ্জ থেকে সদরঘাট আসতে খুব একটা সময় লাগল না।ঘাটে এসেই কেবিনের খোঁজ করলেন বাবা।কিন্তু এমভি অভিযান-১০ নামের লঞ্চটায় কোনো কেবিন ফাঁকা নেই।বাধ্য হয়ে দোতলায় লঞ্চকর্মীদের কেবিনটার পাশে ফাঁকা জায়গায় চাদর বিছিয়ে বসে পড়ি আমরা।
২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর।সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা। সাইরেন বাজাতে বাজাতে ঘাট ছাড়ে লঞ্চ।শীতের সন্ধ্যা দ্রুতই নেমে আসে।নদীর পাড়ের আলোয় আলোকিত চারপাশ। ডেকে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকি।আমার দাদুবাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলায়।প্রায় সাড়ে চার বছর পর দাদুবাড়ি যাচ্ছি। ছোটবেলায় যাওয়ার সময় কী করতাম,সেসব নিয়ে গল্প করছিলাম।মা বারবার বলছিলেন,বিয়ের পর এই প্রথম নাকি ডেকে বসে লঞ্চে যাচ্ছেন তিনি।
আমার ছোট ভাই সাদিক এসএসসি পাস করার পর মায়ের নতুন মুঠোফোন পেয়েছে।সে মুঠোফোনে বুঁদ।আমাদের আশপাশে আরও কয়েকজন এসে বসেছেন। তাঁদের সঙ্গেও টুকটাক কথা বলছিলাম।
চাঁদপুর ছাড়ার পর রাতের খাবার খেতে বসি।লঞ্চের ডাল চচ্চড়ি আমার ভীষণ প্রিয়।বাসা থেকেও কিছু খাবার আনা হয়েছিল।সবাই ভাগাভাগি করে খেয়ে নিই।তারপর আবার গল্প। বাবা মাঝেমধ্যে আমাদের মা–মেয়ের গল্পে দু–একটি শব্দে নিজেকে যুক্ত রাখেন।
রাত ১১টা। এমভি অভিযান-১০ বরিশালে পৌঁছায়।ঘাটে ভিড়ে একটি লম্বা বিরতি দিল।যত যাত্রী নামলেন,তার চেয়ে উঠলেন বেশি।যাত্রীতে গমগম করছিল চারপাশ।এদিকে ক্লান্তিতে তখন ঘুমঘুম চোখ আমার।ছোট ভাই আর আব্বু আগেই ঘুম। আমিও জায়গা করে নিয়ে মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়ি।
মাঝ রাতে হঠাৎ ‘আগুন, আগুন’ চিৎকারে ঘুম ভাঙল।ধড়ফড় করে উঠে বসি।গভীর ঘুম থেকে জাগার পর যেমনটা হয়, তৎক্ষণাৎ কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।শুধু দেখলাম, মানুষ ছোটাছুটি করছে।মা আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন। আর বলছেন, ‘নিচে নামতে হবে।’
তড়িঘড়ি উঠে এগিয়ে যাই সিঁড়ির দিকে।সিঁড়ির সামনে বিরাট জটলা।সবার চোখেমুখে আতঙ্ক।আমরা চারজন একজন আরেকজনের হাত ধরি।মানুষের স্রোতে নিচে নামার চেষ্টা করি।এমন সময় বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে লঞ্চ।
এতক্ষণ আলো ছিল।বিস্ফোরণের পর চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেল।ধোঁয়ায় দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আমরা একজন আরেকজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। মুহূর্তে তপ্ত তাওয়া হয়ে গেল লঞ্চটা। আমি সরে এসে কাপড়ের একটা ব্যাগ পেয়ে সেটার ওপর দাঁড়াই। দুইটা বাচ্চা নিয়ে একজন মাকে দেখলাম গরমে কাতরাচ্ছেন। আমার সামনেই ওরা।খুব কষ্ট হলো দেখে।
ধোঁয়া আর তাপ বেড়েই যাচ্ছিল। অসহনীয় আঁচ অনুভব করছিলাম।ভাপে যেমন আটা সেদ্ধ হয়ে ভাপা পিঠা হয়, মনে হচ্ছিল ঠিক সেভাবে সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছি।তবে মনে হচ্ছিল, চারপাশে এত পানি, নিশ্চয়ই নিভিয়ে ফেলা হবে। তখনই টুপ করে আমার হাতে পানি পড়ল। কেউ কি আগুন নেভাচ্ছেন? বুঝতে পারলাম আমার হাতের চামড়া গলে পড়ছে। আঙুলে আংটি ছিল, পায়ে নূপুর ছিল, অলংকার গুলো গরম হয়ে শরীরের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার অবস্থা। মনে হলো, বাঁচতে হলে দ্রুত নিচে নেমে যেতে হবে।
অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে কীভাবে নিচতলায় নেমে এসেছি, তা এখন আর মনে নেই। তবে নিচতলায় নেমে শুয়ে পড়েছিলাম মনে আছে। আগুনের তাপে চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে আগেই। তাই কিছুই দেখতে পাচ্ছিছিলাম না। মনে হচ্ছিল, আমি হয়তো আর বাঁচব না।
একসময় আমার ছোট ভাই এসে আমাকে তুলে নেয়। ততক্ষণে লঞ্চটা ছোট একটি চরে ভিড়েছে। সেই চরে নামানো হয় সবাইকে। নামার এক কি দেড় মিনিটের মধ্যে বিকট শব্দে আবার বিস্ফোরণ হলে পুরো লঞ্চে আগুন ধরে যায়। পরে জেনেছি, আমার বাবা নামতে গিয়ে পানিতে পড়ে যান। তাঁকে উদ্ধার করে চরে তোলা হয়।
মায়ের খোঁজ তখনো আমরা জানি না। সাদিক নানান জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছে, পায়নি। আমাকে স্থানীয় মানুষের সহায়তায় নেওয়া হয় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে। সেখানে ব্যান্ডেজ পরিয়ে পাঠানো হয় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
ওয়ার্ডে যখন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম, পাশ থেকে ডেকে আমাকে আর সাদিককে ডাকেন মা। আমার পাশের বিছানায় ছিলেন তিনি। চোখ বন্ধ আমার। তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। সেটিই মায়ের সঙ্গে আমার শেষ স্মৃতি।
যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ছিলাম। বরিশাল থেকে পরদিন আমাদের আনা হয় ঢাকায়। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের স্টেপ-ডাউন ইউনিটে (এসডিইউ) আমার জায়গা হয়। শরীরের ২৫ শতাংশ পোড়া। শ্বাসনালি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত।এসব সারিয়ে তুলতে চিকিৎসা চলে। কয়েক দফায় অস্ত্রোপচার হয়।
শুরুতে অনেকে এসে মায়ের খবর দিত। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর আত্মীয়স্বজন, চিকিৎসক, ওয়ার্ডবয় কেউ আর মায়ের কথা বলেন না। সবাই কেমন যেন এড়িয়ে যেতে থাকেন। কিছু বললে ঘুরিয়ে–পেঁচিয়ে বলে। আমি বুঝতাম, তাঁরা কিছু লুকানোর চেষ্টা করছে।
২ ফেব্রুয়ারি ২০২১। করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছাড়পত্র দেয়। বাড়ি ফিরে আসি। তারও দিন সাতেক পর জানতে পারি, মায়ের মৃত্যুর খবর। ২৯ ডিসেম্বর তিনি হাসপাতালে মারা গেছেন। বাবাও আমার মতো হাসপাতালে ছিলেন তখন। ছোট ভাই সাদিক একা সব সামলে নিয়েছে|
পাঁচ মাস পর প্রথম বিছানা ছেড়ে হাঁটতে শুরু করি। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছি। যদিও শারীরিক অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। অস্ত্রোপচারের পরও চোখের সমস্যাটি প্রকট। হাঁটতেও কষ্ট হয়। হাতে ভারী কিছু নিতে পারি না। তবু জীবনটা নতুন করে শুরু করতে হবে। পড়াশোনা ও চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সবই বুঝি; কিন্তু মাঝে মধ্যে কিছুই মেলাতে পারি না। মনে হয়, জীবনটা কোথায় যেন থমকে আছে।