মাসুমা জাহান,বরিশাল ব্যুরো:
দূর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ কার্পেট মোড়ানো।আসলে এগুলো কার্পেট নয়।একধরনের উদ্ভিদ।পাতার সরু লতায় দুধ সাদা ফুলের পাপড়ি গুলো মেলে ধরে এর অনন্য শোভা।এই উদ্ভিদ বেশি মোহনীয় হয়ে ওঠে শীতের শিশিরসিক্ত ভোরে। পাতার ওপরে শিশির বিন্দুতে সকালের নরম রেদের আলো পড়লে মুক্তার মতো চিকচিক করে ভিন্ন এক দ্যুতি ছড়ায়। তখন সবুজ গাঢ় পাতার ফাঁকে ফাঁকে বিন্যস্ত ফুল গুলো প্রশান্তির আবহ তৈরি করে।
অনাদরে বেড়ে ওঠা এই বুনো উদ্ভিদের জাতটি আমাদের চারপাশে ছিল একসময়।কিন্তু নগরায়ণের জোয়ারে এরা গুটিয়ে গেছে।তাই সহজে এদের দেখা মেলে না। তবে গ্রামের ফাঁকা মাঠ,বাড়ির আঙিনার স্যাঁতসেঁতে জায়গায় কিংবা গাছের শিকড়ে সুযোগ পেলেই এরা বেড়ে ওঠে।উদ্ভিদটির নাম ‘ভুঁই আঁকড়া’।
নিসর্গবিদদের মতে,উদ্ভিদটি কলমির একটি প্রজাতি। বাংলাদেশে বহু প্রজাতির কলমি ফুল রয়েছে। তবে সবচেয়ে খুদে কলমি ফুল হচ্ছে এই ভুঁই আঁকড়া। দেশের সব জেলায় এ উদ্ভিদটি দেখা যায়। এর ফুলের আকার ছোট হওয়ায় ভালোভাবে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে খুব কাছে গিয়ে পরখ করতে হয়। ভূমি আঁকড়ে ধরে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে মৃত্তিকাশ্রয়ী মায়াময় এই উদ্ভিদ। এ জন্যই আমাদের দেশে উদ্ভিদটির প্রচলিত নাম ভুঁই আঁকড়া। উদ্ভিদটির কাণ্ডের গোড়া থেকে শিকড় গজায়। পাতা ও কাণ্ডের যুক্ত স্থান থেকে একটি করে কলি বের হয়। ফুলে পাঁচটি পাপড়ি থাকে, পাপড়ির প্রস্থ ৭ থেকে ৮ মিলিমিটার পর্যন্ত হয়।
ফুল ফোটে অক্টোবর থেকে জানুয়ারিতে। তবে শীতের সময় ফুল বেশি দেখা যায়। বীজের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি ঘটে এর। সংস্কৃত নাম মুসাকারনি। যার অর্থ হলো ইঁদুরের কানের মতো পাতা। ভুঁই আঁকড়ার আদি নিবাস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা। উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়া এক উদ্ভিদ। ভারত উপমহাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে খুব নিবিড় সখ্য গড়ে নিয়েছে এটি। রোদের আলো ও হালকা ছায়াময় পতিত জমি কিংবা সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত বাড়ির উঠান ও রাস্তার আশপাশে এই উদ্ভিদ নীরবে বেড়ে ওঠে। এর ছোট ছোট ফুলে মৌমাছি, পিঁপড়া ঘুরঘুর করে মধুর সন্ধানে।
বরিশাল নগরের চৌমাথা থেকে পশ্চিমে মাকরকাঠী গ্রাম। এই গ্রামের মিয়াবাড়িতে সম্প্রতি দেখা মেলে ভুঁই আঁকড়ার। নিবিড় ভাবে মাটি আঁকড়ে নীরবে একগুচ্ছ আঁকড়া দলের বেড়ে ওঠার এই দৃশ্য অপরূপ লাগে। মৃত্তিকাকে আঁকড়ে রাখার এই খুব মায়াময় লাগে।বাংলার প্রকৃতির এমন মোহনীয় রূপ দেখে মনে পড়ে প্রকৃতিপ্রেমী কবি জীবনানন্দ দাশের সেই জনপ্রিয় কবিতা।তিনি কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে আবার এই বাংলায় ফেরার আকুতি জানিয়েছিলেন ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায়। হয়তো বা হাঁস হব- কিশোরীর–ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,সারা দিন কেটে যাবে কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে ভেসে; আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে।