লেখক, জসীমউদ্দীনঃ
বছিলা রোড দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ কানে বাজছে, একজন ক্রেতা ভ্যানে করে মাল বিক্রেতাকে বলছেন, সরকার তো জিনিসপত্রের দাম কমানোর কথা বলছে। আপনারা কেন বেশি ধরে বিক্রি করছেন। বিক্রেতা বলছেন, সরকার সরকারের মতো কথা বলছে, এটা আপনি বিশ্বাস করতে যান কোন দুঃখে। আমরা তো সাধারণ বিক্রেতা, যেখান থেকে মালগুলো আনি, তা নিয়ন্ত্রণ করে সরকারি দলের লোকজনই। তারা যদি কম ধরে বিক্রি করে, তাহলে আমরা কম ধরে বিক্রি করব। সরকার কথার কথা বলছে যে জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। এটা সরকারের আসল কথা নয়। কারণ, জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির পেছনে সবাই সরকারের লোক। খোঁজ নিয়ে দেখুন, সরকারের একদিকে বলছে জিনিসপত্রের দাম কমাও, অপর দিকে বলছে এটা কথার কথা, তোমাদেরটা তোমরা চালিয়ে যাও।
এই কথাগুলো শোনার পর কানকে বিশ্বাস করতে চিন্তায় পড়ে গেলাম। এসব কী বলে? সরকারের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কোথায় এসেছে ঠেকেছে?
নির্বাচনের আগে যে গরুর গোশত ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হতো। নির্বাচনের পর তা ৮০০ টাকা হয়ে গেছে। কারা এগুলো করছে? সরকারকে তা খতিয়ে দেখতে হবে।
বর্তমান সরকারের অতীত ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করে অনেকেই ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গটা নিয়ে আসেন। সেই সময়কার বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতি শুনলে-দেখলে একটি ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়, একটা শ্রেণি ব্যবসার নামে দেশের জনগণকে না খাইয়ে মজুতদারি-মুনাফাখুরি করে দেশে দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে ছিল।
সদ্য স্বাধীন শিশু রাষ্ট্রটিকে পরিচর্যা করে হাঁটি হাঁটি পা পা করে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা না করে, কীভাবে মজুতদারি, মুনাফাখুরি, কালোবাজারি করে দেশে দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে ছিল।
আজ বিশ্ব বাস্তবতার এবং দেশের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, রাষ্ট্রের একটু সংকটে আছে।
এখানে প্রতিটি মানুষের দেশপ্রেমের দায়বদ্ধতা প্রয়োজন। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষেরই দেশপ্রেমের দায়বদ্ধতা বলে কিছু আছে- এমনটি উপলব্ধি করার জন্য গবেষণা প্রয়োজন নেই!
দেশটি রাজনৈতিকভাবে গভীর সংকটের মুখে। অপর দিকে বিশ্ব অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অনেকাংশেই উন্নয়নশীল দেশের কাছে দায়বদ্ধ। এখানে অনেক লোক গার্মেন্টসে চাকরি করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। আর গার্মেন্টস সামগ্রীর মূল ক্রেতা উন্নত বিশ্ব।
অপর দিকে বিশ্ব দুটি বিভক্ত।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সবার সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয়। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি চায়, শতভাগ তাদের প্রতি আনুগত্য।
দেশে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা হেন কোনো কর্মকাণ্ড নেই যে করে না, কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বা জোটের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে তারা শুধু পরাজিত নয়, একেবারে হেরে গেছে।
এ অবস্থায় তারা মরণ কামড় দিতে প্রস্তুত।
বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু টেনেল, উড়াল সড়ক, উড়াল সেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ অনেক কিছু হয়েছে। এগুলোর তুলনায় মনুষ্যের মৌলিক অধিকারগুলোর দাম অতি নগণ্য। তাই কেউ কেউ বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি চাল, ডাল, আটা, লবণ, তেল, মাছ, মাংস, ডিম- এগুলোর দাম সরকার চাইলেই সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কেন জানি সরকার এ ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, সরকারপ্রধানসহ তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এ ব্যাপারে কথা বলছেন। কিন্তু যতই কথা বলছেন, ততই দ্রব্যমূল্য না কমে বেড়েই চলছে।
তাহলে কি ভ্যানে করে মাল বিক্রেতা আর ক্রেতার কথোপকথনই সত্য হিসেবে আমরা ধরে নেব! তাহলে কেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে না এসে দিন দিন বাড়ছে।
আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নিম্ন-মধ্যবিত্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আত্মসম্মানের কারণে তারা বলতেও পারছে না, সইতেও পারছে না।
করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এবং হামাস-ইসরাইলের যুদ্ধ। পৃথিবীটা ভয়ংকরভাবে অর্থনৈতিকভাবে অস্থির। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে? এ অবস্থায় আমাদের দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ খুব অসহায়। তাদের বাঁচাতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ঠেকানোর বিকল্প একেবারেই নেই। আগে সরকার এই ব্যাপারে শতভাগ উদাসীন ছিল। বর্তমানে এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিলেও যতই বলছে, ততই জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এটা স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ একেবারেই শেষ।
তবে কিছুদিনের জন্য সেনাবাহিনী নামিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। কারণ, কিছু রাজনীতিক নেতৃত্ব, যারা সরকারবিরোধী; তারা চায় দেশে অস্থিতিশীলতা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিসহ নানা রকম সামাজিক অস্থিরতা। অপর দিকে সরকারি দলের মুনাফা লোভীদের তৎপরতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী নামিয়ে কঠোর অবস্থানে যাওয়া ছাড়া আর বিকল্প কোনো অবস্থা নেই।