জসিম উদ্দীন, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ বোনা হয় বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। আর এই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি সালাম, রফিক, শফিক, জব্বার ও বরকতদের প্রাণের বিনিময়ে। এর ফলে জাতিসত্তার অধিকারের প্রশ্নে ন্যায্যতার খাতিরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল অন্যায়ের প্রতিবাদের মুখশ্রী হয়ে ওঠে একুশে ফেব্রুয়ারি। এরপর পাকিস্তানের পূর্ব অংশের প্রতি সব অন্যায্যতার পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে সত্তরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা দলকে ক্ষমতায় না দেওয়ার কারণে। আর বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির স্বপ্নের বাস্তবায়নে একটি রক্তস্নাত ঐতিহাসিক দিন হিসেবে পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করে।
শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে দেশে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি মহোৎসবে উদযাপিত হয়। যা জাতীয় দিবস থেকে আন্তর্জাতিক দিবসে রূপ লাভ করে।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে প্রতিবছর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় বাঙালির প্রাণের মেলা বইমেলা। আমাদের দেশের কবি, সাহিত্যিক, গল্পকার, উপন্যাসিক তথা সাংস্কৃতিক জগতের মানুষের জন্য এই বইমেলা একটি মহান মিলনক্ষেত্র হিসেবে প্রতিবছর আবির্ভূত হয়। আর সবাই তাকিয়ে থাকে এই ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে।
আগে ভাষার মাস হিসেবে বইমেলা হতো বাংলা একাডেমি চত্বরে। এখন বইমেলা একটি শিল্পে রূপান্তরিত হয়েছে। এর অবয়ব অনেক বড় হয়েছে। লেখক-প্রকাশক-প্রকাশনী বৃহৎ রূপ লাভ করায় এখন বাংলায় একাডেমি ছাড়িয়ে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান দখল করেছে।
বইমেলার অতীত ঐতিহ্য বর্তমানে কিছুটা হলো ম্লান হতে চলেছে। কারণ, কিছু উদ্বাস্তু পরিবারকে কোনো একটি উন্মুক্ত মাঠে এনে ছেড়ে দিলে যদি বলা হয় ষে, তোমরা এখানে ঘর বেঁধে থাকবে। তাহলে যে যার মতো করে ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করবে। অথবা অল্প একটু জায়গায় অধিক মানুষকে থাকতে বললে তারা যেভাবে ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকবে, আমাদেরও মহান বইমেলা আজ সেই রূপ লাভ করেছে। বইমেলায় এলোমেলোভাবে স্টলগুলো সাজানো হয়েছে। বইবেলার মূল গেট দিয়ে প্রবেশ করলে যে স্টলগুলো আছে, সেগুলোতে পাঠকদের যেই দৃষ্টি পড়ে, কিন্তু পেছনের অংশের স্টলগুলোতে পাঠকদের তেমন দৃষ্টি পড়ে না। ফলে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বই বিক্রির তারতম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অপর দিকে এমনিতেই বইয়ের পাঠকের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ফলে কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনা ছাড়া ক্ষুদ্র প্রকাশনা গ্রুপ থেকে বই প্রকাশ করে প্রকাশকদের লোকসান গুনতে হচ্ছে।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে এলোমেলো বই স্টল বরাদ্দ না দিয়ে স্টেডিয়ামের আদলে চারদিকে গ্যালারির মতো বইয়ের স্টল বরাদ্দ দিলে, পাঠক ঘুরে ঘুরে বই কিনতে পারে। এখন এমন অবস্থা যে নির্দিষ্ট স্টল খুঁজতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
বাংলা একাডেমি থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বৃহৎ এলাকা নিয়ে বর্তমানে বইমেলা হচ্ছে। বইমেলার স্টলগুলো স্টেডিয়ামের গ্যালারির সাজের বরাদ্দ দেওয়া হলে পাঠক ঘুরে ঘুরে বই কিনতে কষ্ট হবে না। দ্রুত তার পরিচিত প্রকাশনী খুঁজে পাবে।
এমনিতেই বর্তমান প্রজন্ম বড় অস্থির। তারা ফেসবুক-ইউটিউব দেখে সময় পার করছে। খুব দ্রুত কোনো ঘটনা দেখে বা শুনে আরেক দিকে চলে যাচ্ছে।
বইমেলায় শুক্র এবং শনিবার মোটামুটি লোকসমাগম হয়। অধিকাংশ লোক আসছে ঘোরাফেরার জন্য; বই কেনে না।
আবার কেউ কেউ মোশতাক বা তিশাদের মতো লেখকদের দুয়োধ্বনি দিয়ে আনন্দ পায়। তাদের লেখা বই কতটুকু পাঠ উপযোগী জানা যায়নি। বইমেলা বাঙালি জাতির মেধা-মননের এক স্বীকৃত মিলনমেলা। যেখানে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নও জড়িত।
বইমেলা আর বাণিজ্য মেলায় এক নয়। বইমেলা বাণিজ্য মেলায় রূপ নিলে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদদের আত্মা কষ্ট পাবে।