মাসুমা জাহান,বরিশাল ব্যুরোঃ
বরিশালে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই বাড়ছে ইটভাটার সংখ্যা।সেসব ভাটায় কাঠ দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে ইট। এতে উজার হচ্ছে বনাঞ্চল।পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসব ইটভাটা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় অফিসের দেওয়া তথ্য বলছে,বরিশালের হিজলা উপজেলায় মোট ১৯টি ইটভাটা রয়েছে।এর মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েছে ১৩টি। ছাড়পত্র নেয়নি ৬টি। মোট ইটভাটার মধ্যে ১৪টি জিগজ্যাগ।
কিন্তু বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপ বলছে, এই উপজেলায় মোট ৫৬টি ইটভাটা রয়েছে এবং নিয়মিত ইট পুড়ছে।
এটা শুধু হিজলা উপজেলার চিত্র নয়,পুরো বিভাগের ৬ জেলার ৪২টি উপজেলায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার তথ্যের ফারাক রয়েছে।এমনকি কয়লা ব্যবহার করে ইট পোড়ানোর কথা থাকলেও নামে মাত্র কয়লা রেখে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন,জলবায়ু সংকটের এই সময়ে এভাবে কাঠ ব্যবহার করে ভাটার চুল্লি চালু রাখলে বায়ুমণ্ডলের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি উজার হচ্ছে বনাঞ্চল।সরকারি দপ্তরকে নখদন্তহীনভাবে দায়িত্ব পালন না করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তারা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে,বিভাগে বৈধ ইটভাটার সংখ্যা ৪৯১টি।আর অনিবন্ধিত ইটভাটা ২২৪টি।এই তথ্য নিবন্ধনের আবেদনের ওপর তৈরি করে প্রস্তুত।যারা আবেদন করেনি তারা অবৈধ ভাবে ইটভাটা চালালেও অবৈধ তালিকায় নাম নেই।
এদিকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ১৩টি নতুন ইটভাটার ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।ওই বছর মোট ছাড়পত্র পায় ৩৯২টি।অবৈধ ইটভাটা বন্ধে ৬১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৬৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।আর চলতি বছরের এই মাসে মাত্র দুটি অভিযান পরিচালনা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,অঞ্চলভিত্তিক প্রভাবশালীদের সরাসরি হস্তক্ষেপ বা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই শত শত ইটভাটা পরিবেশ ধ্বংস করে চলছে।এদের বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারণে ব্যবস্থা গ্রহণ করে না পরিবেশ অধিদপ্তর। শুধু তাই নয়,প্রতি বছর উপজেলা উপজেলায় ইটভাটার সংখ্যা বেড়েই চলছে।
বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নে আগে ১১টি ভাটা থাকলেও ২০২২ সালে তা দাঁড়িয়েছে ২৪টি। বাকেরগঞ্জ উপজেলার কলসকাঠি ইউনিয়নে পূর্বে ২১টি ভাটা থাকলেও বর্তমানে ৩২টি ইটভাটা হয়েছে।সেখানে প্রকাশ্যেই পোড়ানো হচ্ছে কাঠ।
হিজলা উপজেলার একটি ইটভাটার মালিক ইয়াছিন মুন্সি দাবি করেন,ডলার সংকটের কারণে কয়লার দাম বেড়েছে কয়েকগুণ।গত বছরের শুরুতে এক মেট্রিক টন কয়লা ছিল ২১ হাজার টাকা।বর্তমানে তা প্রায় ২৫ হাজার টাকা।পরিবহন খরচসহ মূল্য দাঁড়াচ্ছে ২৭ হাজার টাকারও বেশি।কিন্তু টাকা থাকলেও কয়লা পাওয়া যাচ্ছে না।সুনামগঞ্জ থেকে ৩ মেট্রিক টন কয়লা কিনেছেন।যা দিয়ে ১৫ লাখ পিস ইট পোড়ানো যাবে।তাতে এই মৌসুম শেষ করা যাবে না।
বাকেরগঞ্জের একটি ইটভাটার মালিক হাবিবুর রহমান বলেন, কয়লায় ইট পোড়ালে ইটের দাম বেড়ে যায়।বাধ্য হয়ে কাঠ পোড়াতে হচ্ছে।ইটভাটায় পরিবেশের ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছি।কিন্তু এক বছরেও পাইনি।এতে নানা জটিলতা রয়েছে।পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি না করলে ছাড়পত্র পাওয়া যায় না।
নলছিটি উপজেলার একটি ইটভাটার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই জিগজ্যাগ ইটভাটা চালাচ্ছি।ছাড়পত্রের আবেদন আগামী মাসে জমা দেব।তিন বছর ধরে ইটভাটাটি চলছে।
রাজাপুর উপজেলার আরেক ইটভাটা মালিক অভিযোগ করেন,টাকা দিলে বৈধ এবং অবৈধর পার্থক্য থাকে না। যারা ঠিকভাবে টাকা দেয় না, তাদেরকে ইটভাটা বন্ধের জন্য নোটিশ দেওয়া হয়।কিন্তু পরে যোগাযোগ করলেই আবার সব ঠিক হয়ে যায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বরিশাল জেলার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট লিংকন বাইন বলেন, ইটভাটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। অথচ প্রতি বছরই ইটভাটার সংখ্যা বাড়ছে।তার মধ্যে জিগজ্যাগ দেখিয়ে ইটভাটার অনুমোদন নিয়ে ড্রাম-চিমনিতে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরির কারণে বন উজার হচ্ছে। ফসলি জমি,গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।পরিবেশ মারাত্মভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। কিন্তু ছাড়াপত্র দেওয়ার পরে তদারকির যে দায়িত্ব রয়েছে সেটা সঠিকভাবে পালন করছে না পরিবেশ দপ্তর। এটা তাদের ব্যর্থতা। তাদের নীরবতার পেছনে কোনো স্বার্থ কাজ করছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. আব্দুল হালিম বলেন, আমাদের জনবল সংকট। তার মধ্যেও আমরা চেষ্টা করছি অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার। এরই মধ্যে আমরা বাকেরগঞ্জে দুটি অভিযান পরিচালনা করে একটিতে জরিমানা এবং একটি ইটভাটা বন্ধ করে দিয়েছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, ইটভাটার সঙ্গে ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু কে কোন ইটভাটার সঙ্গে যুক্ত সেটা মুখ্য বিষয় নয়। ছাড়পত্র ছাড়া অবৈধভাবে ইটভাটা চালানোর সুযোগ নেই। সে যেই হোক আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।