উত্তম চক্রবর্তী,মনিরামপুর(যশোর)
কালিপদ বিশ্বাস (৪৫) ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন। কয়েক বছর আগে মোটরসাইকেলে করে যাত্রী নিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনায় তিনি ডান পায়ে আঘাত পান। আঘাতের জায়গায় গ্যাংরিন দেখা দেয়। পরে অস্ত্রোপচার করে হাঁটুর নিচ থেকে বাদ দেওয়া হয়। কোনো রোজগার না থাকায় সংসার চলে না। এই অবস্থায় বাঁওড়ের ওপর ভাসমান সেতুর পাশে অন্যের জমির ওপর টিনের ছাপড়া তুলে মুদি দোকান দেন কালিপদ। সেখানে তিনি চা-ও বিক্রি করতেন। গত শুক্রবার রাতে সেই দোকানে ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। আগুন লাগলে দোকানটি পুড়ে ছাই হয় এবং অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান কালিপদ বিশ্বাস। বাবাকে বাঁচাতে এসে দগ্ধ হয়েছেন কালিপদ বিশ্বাসের ছেলে অমিত বিশ্বাস। কালিপদ বিশ্বাস মনিরামপুর উপজেলার রাজগঞ্জের মোবারকপুর গ্রামের বাঞ্ছারাম বিশ্বাসের ছেলে। কালিপদ বিশ্বাসের ছোট ভাই পরিতোষ বিশ্বাস জানান, কালিপদ বিশ্বাস ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন। ১০ বছর আগে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালানোর সময় দুর্ঘটনায় তিনি ডান পায়ে আঘাত পান। আঘাতের জায়গায় গ্যাংরিন দেখা দেয়। পরে অস্ত্রোপচার করে হাঁটুর নিচ থেকে বাদ দেওয়া হয়। তাঁকে চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা খরচ হয়। আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারটি পথে বসার উপক্রম হয়। ২০১৭ সালে রাজগঞ্জের ঝাঁপা বাঁওড়ের ওপরে দ্বিতীয় ভাসমান সেতু নির্মিত হওয়ার পর সেতুর পূর্ব পাড়ে অন্যের জমিতে টিনের ছাপড়া তুলে দোকান শুরু করেন কালিপদ। দোকানে তিনি মুদির মাল ও চা বিক্রি করতেন। রাতে নিয়মিত দোকানে ঘুমাতেন। এই দোকানের ওপর তাঁর সংসার চলত। ২০১৮ সালে স্ট্রোক করেন কালিপদ। পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার দোকানে ফিরে যান। পরিবারে তাঁর স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে আছেন। কালিপদ ভূমিহীন মানুষ। দুই শতক জমির ওপর মাটির দেয়ালের একটি ঘর আছে তাঁর। ওপরে টালির ছাউনি। দোকানদারি করে তিনি মেয়েকে অনার্সে ও ছেলেকে সরকারি পলিটেকনিকে পড়াচ্ছিলেন। দোকানে আগুন জ্বলতে দেখে বাবাকে বাঁচাতে এসে দগ্ধ হয়েছেন কালিপদ বিশ্বাসের ছেলে অমিত বিশ্বাস (১৭)। তাঁকে যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তার অবস্থাও ভালো না। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় বার্ণ ইউনিটে নেওয়া জরুরী। কিন্তু চিকিৎসার খরচ দেওয়ার মতো কোনো টাকা নেই পরিবারের হাতে। কালিপদ বিশ্বাসের প্রতিবেশী সঞ্জয় চৌধুরী বলেন, শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তাঁর দোকানে চা পান করে আমরা গ্রামে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাই। আমাদের সঙ্গে কালিপদ বিশ্বাসও গিয়েছিলেন। রাত প্রায় তিনটার দিকে তিনি দোকানে ফেরেন। এরপর ভোর পাঁচটার দিকে তাঁর দোকানে আগুন জ্বলতে দেখে আমরা দৌড়ে এসে ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়েছি। তারপর ফায়ার সার্ভিসের লোক আসে। ভোরে বাবাকে পুড়তে দেখে তাঁকে উদ্ধার করতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছেন ছেলে অমিত বিশ্বাস। স্বামী কালিপদ বিশ্বাস আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে হাসপাতলের শয্যায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে একমাত্র ছেলে অমিত বিশ্বাস। মলিনা বিশ্বাসের (৩৫) চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকছেন। মাঝে মাঝে ডুকরে কেঁদে উঠছেন। বুক চাপড়ে বিলাপ করছেন, আমরা এখন কী করে বাঁচবো। কালিপদ বিশ্বাসের মেয়ে রিপা বিশ্বাস(২০) বলেন, আমি যশোর সরকারি সিটি কলেজে বাংলা বিষয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ছি। আমার ভাই আমিত বিশ্বাস যশোর সরকারি পলিটেকনিকে তৃতীয় সেমিস্টার পরীক্ষা দিয়েছে। আমি বাড়ি থেকে গিয়ে কলেজে ক্লাস করি। ভাই যশোরে থাকে। দুই শতক জমির ওপর একটি মাটির ঘর ছাড়া আমাদের আর কিছুই নেই। বাবার দোকানের আয় দিয়ে আমাদের সংসার চলতো। আমরা দুই ভাই-বোন লেখা করতাম। বাবার ইচ্ছা ছিল আমার ভাই ইঞ্জিনিয়ার হবে। পরিবারে আর দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেলো। এখন কী করে আমরা লেখাপড়া করবো, আর কী করই বা ভাইকে বাঁচাবো।