মোঃ আরিফুজ্জামান সাগর, নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের যুবসমাজকে নার্সিং শিক্ষা গ্রহণ এবং বৃহৎ পরিসরে সেবা প্রদানে নিয়োজিত থাকার আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, আমি দেশের যুব সমাজকে নার্সিং শিক্ষা গ্রহণ এবং সেবায় নিয়োজিত হওয়ার আহবান জানচ্ছি। নার্সের শিক্ষা গ্রহণ করলে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও কর্মসংস্থান হবে।
উন্নত সেবা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে পারলে নিজেরও একটা আত্মতৃপ্তি আসবে, বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে গাজীপুরের কাশিমপুরে ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে নার্সিং কলেজ’ এর দ্বিতীয় স্নাতক সমাপনী অনুষ্ঠান-২০২৩ এ প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, সবসময় এটা মনে রাখতে হবে যারা আজকে গ্রাজুয়েট হলেন, ডিগ্রি পেলেন, তাদেরকে জনগণকে সেবা দেওয়ার কথা সবসময় মনে রাখতে হবে। একজন রোগী চিকিৎসা এবং ওষুধে যতটা না সুস্থ হবে ডাক্তারদের সহানুভূতি এবং নার্সদের সেবা পেয়েই কিন্তু তার চেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে পারে। তাদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে।
তিনি বলেন, যারা ৪ বছর কঠোর অধ্যবসায়ের ফসল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তারা নিশ্চই জনগণের সেবায় নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করবেন। আপনাদের অর্জিত জ্ঞান আপনারা কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করবেন। সকল ক্ষেত্রে যেমন বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে এই ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাবে, সেটাই আমি চাই।
তিনি এ সময় সেবাধর্মের প্রতীক বিশে^র খ্যাতনামা নার্স ও মানবসেবী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের কথা উল্লেখ করেন, যিনি মানব সেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টের চেয়ারম্যান শেখ হাসিনা এই নার্সিং কলেজ ও হাসপাতালের সঙ্গে ট্রাষ্টের পক্ষ থেকে একটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করবেন বলে ও জানান। এজন্য জমিও নেয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে স্পেশালাইজড হসপিটাল অ্যান্ড নার্সিং কলেজ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে নামকরণ করা হয়েছে এবং এটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে স্পেশালাইজড হসপিটাল অ্যান্ড নার্সিং কলেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ তৌফিক বিন ইসমাইল এবং দ্বিতীয় ব্যাচের স্নাতক শিক্ষার্থী আনামুল হক।
স্নাতক বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন কেপিজে হেলথকেয়ার বেরহাদের সভাপতি নরহাইজাম বিনতি মোহাম্মদ।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে নার্সিং কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ মল্লিক এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী কলেজের ২১০ জন স্নাতকের মধ্যে সনদপত্র বিতরণ করেন। তিনি ছয়জন স্নাতক শিক্ষার্থীকে তাদের অসামান্য একাডেমিক রেকর্ডের জন্য ‘প্রাইমিনিস্টার্স এওয়ার্ড’ ও তুলে দেন।
অনুষ্ঠানে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে নার্সিং কলেজের ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালের ওয়েবসাইট, হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার এবং মেডিকেল জার্নালও উদ্বোধন করেন।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক দ্বীন মো. নূরুল হক প্রধানমন্ত্রীর কাছে কেপিজে ঢাকা জার্নাল অব মেডিকেল সায়েন্সের একটি সংখ্যা হস্তান্তর করেন।
এছাড়া বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি স্লিট ল্যাম্প ও অপারেটিভ মাইক্রোস্কোপের ডামি হস্তান্তর করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা ১৯৯৪ সালের ১১ এপ্রিল জাতির পিতার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে জাতির পিতা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এই ট্রাস্ট বিভিন্ন সেবাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বিভিন্ন সময়ে এই ট্রাস্টের মাধ্যমে সারাদেশে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। বিশেষায়িত এই হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা ট্রাস্টের একটি মানবিক উদ্যোগ। এর মাধ্যমে ট্রাস্টের স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পেয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দাতোসেরি মোহাম্মদ নজিব বিন তুন আব্দুল রাজাক, ট্রাস্টের সহ-সভাপতি শেখ রেহানা এবং আমি মিলে ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর এখানে বিশেষায়িত হাসপাতালের উদ্বোধন করি এবং নার্সিং সেবাকে গুরুত্ব দিয়ে এই নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করি। গ্রাজুয়েট নার্স যাতে হতে পারে সে ব্যবস্থা আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রথমেই আমরা নিয়েছি।
তিনি বলেন, বর্তমানে সারাবিশ্বে নার্সিং পেশার গুরুত্ব বাড়ছে, খ্যাতি বাড়ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অ্যানালিটিক প্রতিষ্ঠান ‘গ্যালাপ’ এর হিসেব অনুযায়ী ২০২১ সালের মতো আবারও ২০২২ সালে নার্সিংকে সবচেয়ে বিশ্বস্ত পেশার খ্যাতি দেয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসক ও নার্সবৃন্দ সেবা দিয়ে গেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার সময়ই জাতির পিতা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং নির্যাতিত মা-বোনদের সুচিকিৎসার জন্য সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ইংল্যান্ড, ভারত ও আমেরিকা থেকে ডাক্তার ও স্পেশাল নার্স নিয়ে এসে তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন চিকিৎসা শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। নার্সিং পেশার সম্মান বৃদ্ধি, নার্সিং সেবা ও টেকনোলজির উন্নয়নে তিনি সংশ্লিষ্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
সরকার প্রধান বলেন, তাঁর সরকার জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নার্সিং পেশাকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করেছে এবং এই সরকারের মেয়াদে প্রায় ৪০ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছে। তাছাড়া, অভিজ্ঞতার জন্য চাকরির বয়সসীমাও শিথিল করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশে-বিদেশে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে।
তাঁর সরকার মানুষের সেবাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে উল্লেখ করে দেশে প্রথম মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার পর এখন বিভাগীয় পর্যায়েও তাঁর সরকার মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দিচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, পুরাতন ২৩টি নার্সিং ইনস্টিটিউটকে নার্সিং কলেজে উন্নীত করে ৪ বছর মেয়াদী বিএসসি ইন নার্সিং কোর্স ও পোস্ট বেসিক কোর্স পরিচালনা করা হচ্ছে। এছাড়া আরও ১৬টি নার্সিং ইনস্টিটিউটকে নার্সিং কলেজে উন্নীতকরণ প্রক্রিয়াধীন আছে। সরকারি পর্যায়ে বর্তমানে ৬৯টি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা, বিএসসি বেসিক ও পোস্ট বেসিক এবং মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। নার্সিং ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এডভান্সড নার্সিং এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (নিয়েনার) প্রতিষ্ঠা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে দেশের সরকারি স্বাস্থ্য সেবায় ৪৪ হাজার ৫৩৪ জন নার্স ও মিডওয়াইফ কর্মরত আছেন। ২ হাজার ৩৬৭টি শূন্য পদের বিপরীতে সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া ১০ হাজার সিনিয়র স্টাফ নার্স ও ৫ হাজার মিডওয়াইফের নতুন পদ সৃজন প্রক্রিয়াধীন আছে।
বেসরকারি খাতে হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠাকে তাঁর সরকার উৎসাহিত করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, নার্সিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র-ছাত্রীর আসন সংখ্যা বৃদ্ধি, এ শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে শিক্ষক প্যানেল তৈরি, প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রয়োজনীয় শিক্ষকের পদায়ন এবং নার্স ও মিডওয়াইফারিদের জ্ঞান ও দক্ষতা উন্নয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ফলে বিদেশেও চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
‘জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১১’ প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁর সরকার দেশের স্বাস্থ্যখাতকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনামুল্যে প্রদান করছে। এখন সেখানে ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ইনসুলিনও বিনামূল্যে প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে, বলেন তিনি।