গাজী হাবিব, সাতক্ষীরা:
সাতক্ষীরা জেলা সাব রেজিস্ট্রার অফিসের মূল ভলিউম রেজিষ্টার থেকে ৫ টি পাতা ছিঁড়ে তাতে জাল কাগজ জুড়ে প্রমান লোপাটের চেষ্টার অভিযোগে কালিগঞ্জ উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গাজী শওকত হোসেন, কালিগঞ্জের গোবিন্দপুর গ্রামের ইয়াছির আরাফাত (শাওন), স্ট্যাম্প ভেন্ডার এম. এম. শাহজাহান, নকলনবীশ অনল কৃষ্ণ রায় ও অবসরপ্রাপ্ত টি.সি. মোহরার কাজী আবুল বাশারকে পুলিশের হাতে তুলে দেন সাব-রেজিষ্ট্রার রিপন মুন্সী।
সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ এ নথি চুরি হওয়া এবং জাল কাগজ জুড়ে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার ঘটনা জেলায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। জেলা শহর ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে বইছে আলোচনা- সমালোচনার ঝড়।
বুধবার (১৬ অক্টোবর) বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা সামনে আসে। এরপর বিকাল ৩ টা থেকে রাত সাড়ে ১২ পর্যন্ত সাতক্ষীরা সদর সাব- রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে উক্ত ৫ জনকে পুলিশে দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে পুলিশ তাদেরকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠিয়েছে।
জানা যায়, কালিগঞ্জ উপজেলার ধলবাড়িয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম তার সমুদয় সম্পত্তি রেজিষ্ট্রি কোবালা দলিল ৪৫২০/৯৩,৩০৭৭/৯৩, ৪৫১৫/৯৪ ও৩৭৬১/৯৫ এর মাধ্যমে তার স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে হস্তান্তর করে যান। ওই জমির মধ্যে মৌখালি মৌজার তিনটি খতিয়ানে পাওয়া ১৪ বিঘা জমি জাহানারা খাতুন ও লতিফা খাতুন বিঘাপ্রতি বার্ষিক ১২ হাজার টাকায় তাদের দুই ভাই গাজী শওকত হোসেন ও জাফর আলী গাজীর কাছে ২০১৯ সালে ইজারা দেন। ইজারা গ্রহীতা শওকত হোসেন বোনদের প্রথমে কিছু টাকা দিলেও পরবর্তীতে কোন টাকা দেন নাই।
এ ঘটনায় শ্যামনগর উপজেলার ভুুরুলিয়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা শিকারীর ছেলে ইমরান হোসেন তার মা ও খালার সাত লাখ ৯২ হাজার বকেয়া ইজারার টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগে মামা গাজী শওকত হোসেন ও জাফর গাজীসহ তাদের পরিবারের সাত সদস্যের বিরুদ্ধে গত ১০ অক্টোবর সাতক্ষীরার ২নং আমলী আদালতে মামলা দায়ের করেন।
বিচারক মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। মামলার বিষয়টি জানতে পেরে দুই বোনের নামীয় জমির দলিলের প্রমান নষ্ট করতে জেলা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের কতিপয় কর্মকর্তার সঙ্গে কয়েক লাখ টাকা আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে চারটি দলিলের বালাম বই থেকে ৫ টি করে পাতা ছিঁড়ে নষ্ট করে শওকত হোসেনর পরিকল্পনায় তাতে জাল সত্যায়িত ভলিউমের কপি জুড়ে দেয়া হয়।
বিষয়টি বুধবার সন্ধ্যার পর সাংবাদিকদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শওকত চেয়ারম্যানের ভাগ্নে ইমরান হোসেনসহ কয়েকজন জেলা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে ছুঁটে আসেন। আর বিকালেই আটককৃত ভাইপো শাওনকে ছাড়াতে আসেন চেয়ারম্যান গাজী শওকত হোসেন।
এরপর রাতভর বিভিন্ন নাটকীয় ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়ে জেলা জুড়ে। সকাল থেকে জেলার সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে স্টাডি শুরু করলে শহরের মোড়ে মোড়ে চলে আলোচনা।
পরে দুদকে মামলার প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করে চেয়ারম্যান গাজী শওকত হোসেনসহ ৫ জনকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে আদালতে পাঠায় পুলিশ।
সাতক্ষীরা সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের রেজিষ্টার রিপন মুন্সি বলেন, আমি তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা প্রথমে স্বীকার না করলেও পুলিশে খবর দেয়ার আগে তারা নিজেরা লিখিত জবানবন্দী দিয়েছে। আমি গুরুত্বপূর্ণ এ ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা পেয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেই।
তবে জেলা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের রেকর্ড কিপার প্রদীপ ঘোষ চারটি দলিলের ভলিউম রেজিষ্টারের পাতা ছেঁড়া ও তাতে সত্যায়িত কপি সংযোজনের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, তিনি প্রথমে বাদি হয়ে মামলা করলেও পরে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। মামলাটি দুদকে করা হয়েছে।
এদিকে স্থানীয়রা জানান, ধলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হোসেন সুবিধাবাদি গোষ্ঠীর প্রধান হোতা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন দলের নেতাদের হাতে ফুলের তোড়া ও মুখে মধু দিয়ে ওই দলে যোগদান করতে ওস্তাদ গাজী শওকত হোসেন। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে শওকত হোসেন আওয়ামী লীগের তৎকালিন সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আহম্মেদ এর হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে দলে যোগদান করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়।
সাতক্ষীরা সদর থানার পুলিশ পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম জানান, জেলা সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের রেকর্ড কিপার প্রদীপ কুমার ঘোষ বৃহস্পতিবার গ্রেপ্তারকৃত ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিলেও উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি দুদকের এখতিয়ারে পড়ে মর্মে প্রতীয়মান হওয়ায় সদর সাব রেজিষ্টিার রিপন মুন্সিকে দুদকে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। একপর্য়ায়ে বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) বিকেলে উক্ত পাঁচজনকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে।