মাসুমা জাহান,বরিশাল ব্যুরো:
সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে নৌকার ভেতরে থাকা মাটির চুলায় রান্না করছেন হরেকৃষ্ণ মাঝি (৫৫)। রান্নার তালিকায় আছে সুগন্ধা নদী থেকে নিজ হাতে ধরা আইড় মাছ।সঙ্গে কাঁচকলার ঝোল।রান্না শেষে খাওয়াদাওয়া করে সারা দিন নদীতে মাছ ধরবেন জেলে হরেকৃষ্ণ।এরপর শেষ বিকেলে মাছ নিয়ে বিক্রি করতে যাবেন শহরের পূর্ব চাঁদকাঠি বাজারে।
এভাবেই সকাল শুরু হয় হরেকৃষ্ণসহ ঝালকাঠির পৌর শহরের সুগন্ধা নদীতে নৌকায় থাকা জেলেদের।সারা দিন মাছ ধরে শহরের গুরুধাম সেতুসংলগ্ন সুগন্ধা নদীর মোহনায় শতাধিক জেলে রাতে অবস্থান করেন। জীবিকার তাগিদে পরিবার ছেড়ে তাঁরা নৌকায় বিকল্প সংসার পেতেছেন।এর মধ্যে অনেকের বাড়ি পাশের সুগন্ধা নদীর তীরবর্তী জেলে পাড়ায়।আবার অনেক জেলে পাশের স্বরূপকাঠি থেকেও এসে এখানে অবস্থান করেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সংসারের খরচের টাকা দিয়ে আবার নৌকায় ফিরে আসেন। অনেক জেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়েও বছরের ছয় থেকে সাত মাস নৌকায় কাটিয়ে দেন। সে ক্ষেত্রে স্ত্রী রান্নার কাজে সহায়তা করেন। আর জেলেরা মাছ ধরা ও বিক্রিতে ব্যস্ত থাকেন।
জেলেদের নৌকায় হাঁড়ি, পাতিল, মাটির চুলা, জ্বালানিকাঠসহ কাঁথা-বালিশ ছাড়াও প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র থাকে। রাতে বৃষ্টির হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে অনেক জেলে নৌকায় মোটা পলিথিন মুড়িয়ে দেন। মশার কামড় থেকে বাঁচতে অনেকে মশারি ব্যবহার করেন। একেকটি নৌকায় সাধারণত দুই থেকে তিনজন মানুষ থাকতে পারেন। ডিঙি আকারের কিছু নৌকাও আছে। এসব নৌকার জেলেরা স্থানীয় বাসিন্দা। তাঁরা রাতে নৌকায় অবস্থান করেন না। রাতে বাড়িতে চলে যান।
সম্প্রতি গুরুধাম খালে কথা হয় হরেকৃষ্ণ,মৃত্যুঞ্জয়, বিপ্লব মালো,রতন মালো, নিত্যনন্দ, সদয় নন্দসহ প্রায় ১৫ জন জেলের সঙ্গে।জেলেরা বলেন,নদীর গতি প্রকৃতির ভিন্নতার কারণে সুগন্ধা নদীর মোহনায় আইড়, পাঙাশ, ইলিশ, বড় চিংড়ি, বাইম, বেলে (বাইলা), পোয়া, রামছোঁচসহ বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যায়। এ নদীর মাছের স্বাদও অতুলনীয়। তাই ক্রেতাদের কাছে সুগন্ধার মাছের কদর বেশি। নদী থেকে ধরা মাছ প্রতিদিন পূর্ব চাঁদকাঠি বাজারে সকাল-বিকেল দুই বেলায় ডাকে বিক্রি হয়। আবার সকালে বড় বাজারেও কিছু মাছ ডাকে বিক্রি হয়।
তবে জেলেদের অভিযোগ, তাঁরা নিজেদের ইচ্ছেমতো মাছ বিক্রি করতে পারেন না। যেসব ফড়িয়া বা আড়তদারের কাছ থেকে জেলেরা সারা বছর দাদন নেন, মূলত তাঁদের কাছেই নামমাত্র মূল্যে মাছ বিক্রি করতে হয়।
হরেকৃষ্ণ মাঝি (৫৫) বলেন, ‘নদী, নৌকা আর জালের মধ্যেই আমাদের জীবনটা আটকে গেছে। কূলে উঠলেও শান্তি পাই না। নদীতেই ভালো লাগে। তবে মাঝেমধ্যে পরিবারের কথা মনে পড়ে।
জেলে বিপ্লব মালো (৪০) বলেন, সারা বছর পরিবারের খরচ চালাতে গিয়ে বিভিন্ন মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিতে হয়। আবার মাছ ডাকে বিক্রির সময়ও দাদনদাতার বেঁধে দেওয়া দামেই বিক্রি করতে হয়।
মৃত্যুঞ্জয় মালো (৪৫) বলেন, সারা বছর নৌকা ও জাল মেরামতে অনেক টাকা খরচ হয়। আবার মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় আয় রোজগার বন্ধ থাকে।তখন মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিতে হয়।তাই সারা দিন রোদ-বৃষ্টিতে পুড়ে যে মাছ পাওয়া যায়, সেটা বিক্রি করে দেনা শোধ করতেই টাকা শেষ হয়ে যায়। পরিবারের খরচের জন্য আর কিছু জমা থাকে না।
ওই দিন বিকেলে শহরের পূর্ব চাঁদকাঠি বাজার ঘুরে দেখা যায়, সন্ধ্যার আগে জেলেরা মাছ নিয়ে ডাকে তোলার জন্য হাজির হয়েছেন। সুগন্ধার সুস্বাদু মাছ কিনতে ক্রেতাদের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। সন্ধ্যা নামার পরই দেবু মালো নামে এক মধ্যস্বত্বভোগী (দাদনদাতা) ব্যাগ থেকে মাছ ঢেলে ডাকের জন্য হাঁকডাক দিচ্ছেন। প্রতিটি ডাক থেকে তিনি ক্রেতাদের কাছ থেকে ১০ ভাগ কমিশন নিচ্ছেন আবার আধা কেজি পরিমাণ মাছ রেখে দিচ্ছেন।
বাজারে মাছ কিনতে আসা চাকরিজীবী মেহেদী হাসান বলেন, এখানে জেলেরা মাছের ন্যায্য দাম পান না। সব সুবিধা পান মধ্যস্বত্বভোগীরা। তবে সুগন্ধার মাছ স্বাদে অতুলনীয়।
জানতে চাইলে দেবু মালো বলেন, ‘আমরা জেলেদের বিপদ–আপদে বিশ্বাসের ওপর লাখ লাখ টাকা দাদন দিয়ে থাকি। তাই জেলেরাও আমাদের কিছু সুবিধা দিয়ে থাকে। এখানে দোষের কিছু নাই।